যুগকথা প্রতিবেদনঃ
আজ ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ জেলা গোপালগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। আজ গোপালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গৌরবের দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে গোপালগঞ্জ শহর পাকিন্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিল। এই দিনে সূর্য ওঠার সাথে-সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে-দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করেন। হাতে তাদের উদ্যত রাইফেল ও বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত রক্তলাল সূর্য সম্বলিত গাঢ় সবুজ জমিনের পতাকা। মুখে বিজয়ের হাসি। আজ আর শহরে হানাদার বাহিনী নেই। আজ এ শহর মুক্ত। আজ এ শহর সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের দখলে।
২৭ মার্চ থেকেই গোপালগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গোপালগঞ্জ মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। মুসলিম লীগ নেতাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ এপ্রিল শহরে প্রবেশ করে। তারা প্রথমে শহরের ব্যাংক পাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়) পুড়িয়ে দেয়। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা ১০-১২টি দলে বিভক্ত হয়ে শহরের হিন্দু অধ্যষিত স্বর্ণপট্রি, সাহাপাড়া, সিকদারপাড়া, চৌরঙ্গী এবং বাজার রোডে লুটপাট করে আগুন দিয়ে প্রায় এক হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে হত্যা আর নারী ধর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদাররা উপজেলা পরিষদের মিনি ক্যান্টনমেন্টের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যা করে গণকবর দেয়। সেখানে নারীদের আটকে রেখে তাদের উপর করা হতো অমানবিক নির্যাতন।
৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে। চারিদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ বলয় রচিত ও মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লগ্নে মিত্রদেশ ভারত প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ায় এখানকার পাক হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করবে এমন সংবাদ পেয়ে পাক সেনারা ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানা উপজেলা পরিষদ (বর্তমানে) সংলগ্ন জয় বাংলা পুকুর পাড়ের মিনি ক্যান্টমেন্ট ছেড়ে পালিযে যায়। মেজর সেলিমের অধীনে পাক হানাদার বাহিনীর একটি দল ঢাকায় পালিয়ে যায়। অন্য একটি দল চলে যায় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়ার ওয়ারলেস ক্যাম্পে।
৭ ডিসেম্বর ভোরে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিযোদ্ধারা, আর সেই সঙ্গে মুক্ত হয় গোপালগঞ্জ শহর ও এর আশপাশ এলাকা।মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ দিন তাই পরম পাওয়ার একটি দিন। শত দুঃখ-কষ্ট ও আত্মত্যাগের পর বিজয়ের আনন্দঘন এক মুহুর্ত। পাক সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়েছে আর মুক্তিযোদ্ধারা শহরের দিকে আসছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিকামী জনতার মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শহরের মুক্তিকামী মানুষ বেরিয়ে আসেন। সূর্যোদয়ের মতো আভা ছড়িয়ে বিস্তৃত করেছিল দিগদিগন্ত। শহরবাসী মেতে উঠেছিল অসীম আনন্দ উৎসবে।
গোপালগঞ্জ মুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান আজো অম্লান হয়ে আছে। আজো এসব বীর সেনানীর মনে শ্রেষ্ঠ স্মৃতি ও উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছে এই মুক্তিযুদ্ধ।
গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও তৎকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সিকদার নূর মোহাম্মদ দুলু বলেন, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ১৯৭১ সালের মার্চে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব শুরু করি। এরপর শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়েছে ২৫টি স্থানে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গোপালগঞ্জ সদর থানা পরিষদ সংলগ্ন জয়বাংলা পুকুর পাড়ের মিনি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয়। রণাঙ্গনের সেই ভয়াল স্মৃতি, যুদ্ধদিনের বিবরণ ও গৌরবময় বীরত্বগাঁথা স্মরণ করে আমরা গর্বিত হয়ে উঠি।
প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মুরাদুল ইসলাম বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গোপালগঞ্জের সূর্য সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৭ মার্চ গোপালগঞ্জ মুক্ত হয়। মুক্তিকামী মানুষ বিজয় উৎসবে যোগ দিয়ে স্বজন হারানো বেদনায় অশ্রুপাত করেন। বেদনা ও আনন্দ মিশ্রিত দিনটি শহরের মানুষ উদযাপন করেন।
কাশিয়ানী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মোক্তার হোসেন বলেন, ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জবাসীর কাছে একটি গৌরবের দিন। তাই এ দিনটি আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে উৎযাপন করে আসছি। এ বছরও দিবসটি যথাযথভাবে উদযাপন উপলক্ষে আনন্দ র্যালি, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে। এছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
৭ ডিসেম্বর শহর হানাদার মুক্ত দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধের এ বীর সৈনিকেরা মুখর হয়ে ওঠেন স্মৃতিচারণায়। ফিরে যান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় দিনগুলোতে। রনাঙ্গনের সেই ভয়াল স্মৃতি, যুদ্ধদিনের বিবরণ ও গৌরবময় বীরত্বগাথা স্মরণ করে হয়ে ওঠেন গর্বিত।